কালিমাতুল্লাহঃ রুকু-৪

3383
Total
Visitors

যখন হযরত ইসা আ. বুঝতে পারলেন যে, ফরিসিরা শুনতে পেয়েছেন যে, “তিনি হযরত ইয়াহিয়া আ. এর থেকে বেশি উম্মত বানাচ্ছেন ও বায়াত দিচ্ছেন”- যদিও তিনি নিজে বায়াত দিতেন না কিন্তু তাঁর সাহাবিরা দিতেন- তখন তিনি ইহুদিয়া ছেড়ে গালিলের দিকে ফিরে গেলেন। অবশ্য তাঁকে সামেরিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হলো। সুতরাং তিনি সামেরিয়ার সুখর নামক একটি শহরে এলেন। হযরত ইয়াকুব আ. এর একখণ্ড জমি এই শহরের পাশে ছিলো, যা তিনি তাঁর ছেলে হযরত ইউসুফ আ.-কে দিয়েছিলেন । সেখানে হযরত ইয়াকুব আ. এর একটি কুয়া ছিলো এবং যাবার পথে ক্লান্ত হয়ে হযরত ইসা আ. সেই কুয়ার পাশে বসলেন। তখন বেলা প্রায় দুপুর।

এক সামেরীয় মহিলা পানি নিতে এলে হযরত ইসা আ. তাকে বললেন, “আমাকে পানি দাও।” সেই সময় তাঁর সাহাবিরা খাবার কিনতে শহরে গিয়েছিলেন। মহিলা তাঁকে বললো, “আমি তো সামেরীয়, আপনি ইহুদি হয়ে কেমন করে আমার কাছে পানি চাচ্ছেন?” কারণ সামেরীয়দের সাথে ইহুদিদের ওঠাবসা ছিলো না ।

হযরত ইসা আ. তাকে উত্তর দিলেন, “তুমি যদি আল্লাহর দান সম্বন্ধে জানতে এবং কে তোমাকে বলছেন, ‘আমাকে পানি দাও,’ তাহলে তুমিই তাঁর কাছে চাইতে এবং তিনি তোমাকে জীবন-পানি দিতেন।” মহিলা তাঁকে বললো, “জনাব, আপনার কাছে বালতি নেই এবং কুয়াটাও গভীর। কোথা থেকে আপনি জীবন-পানি পাবেন? আপনি কি আমাদের পূর্বপুরুষ হযরত ইয়াকুব আ. এর চেয়েও মহান? তিনিই আমাদের এই কুয়াটা দিয়েছিলেন আর এখান থেকে তার পশুপালেরা পান করতো এবং তাঁর ছেলেদের সাথে তিনিও পান করতেন?”

হযরত ইসা আ. তাকে বললেন, “যতোজন এই কুয়া থেকে পানি পান করবে তাদের আবার পিপাসা পাবে কিন্তু আমি যে-পানি দেবো তা থেকে যারা পান করবে তাদের পিপাসা পাবে না। আমি যে-পানি দেবো তা তার মধ্যে পানির ঝরনা তৈরি করবে এবং তাকে আল্লাহর সান্নিধ্য পাইয়ে দেবে।” মহিলা তাঁকে বললো, “জনাব, আমাকে সেই পানি দিন , তাহলে আমার আর পিপাসা পাবে না বা পানি নেবার জন্য আর এখানে আসতে হবে না।” 

হযরত ইসা আ. তাকে বললেন, “যাও, তোমার স্বামীকে ডেকে নিয়ে এসো।” মহিলা তাঁকে উত্তর দিলো, “আমার স্বামী নেই।” তিনি তাকে বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছো, ‘আমার স্বামী নেই’, কারণ তোমার পাঁচজন স্বামী ছিলো এবং এখন যে তোমার সাথে আছে সে তোমার স্বামী নয়। তুমি যা বলেছো তা সত্য!” মহিলা তাঁকে বললো, “জনাব, আমি বুঝতে পারছি যে, আপনি একজন নবি। আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই পাহাড়ে এবাদত করতেন কিন্তু আপনারা বলেন যে, যে-জায়গায় মানুষের এবাদত করা উচিত সেটি রয়েছে জেরুসালেম।”

হযরত ইসা আ. তাকে বললেন, “হে নারী, আমাকে বিশ্বাস করো, সময় আসছে যখন তুমি প্রতিপালকের এবাদত এই পাহাড়েও করবে না, জেরুসালেমেও করবে না। তোমরা যা জানো না তার এবাদত করো; কিন্তু আমরা যা জানি তার এবাদত করি, কারণ নাজাত তো ইহুদিদের মাধ্যমে। সময় আসছে এবং এখনই এসে গেছে, যখন প্রকৃত এবাদতকারীরা রুহে ও সত্যে প্রতিপালকের এবাদত করবে, কারণ এরকম এবাদতকারীদেরই তিনি খুঁজছেন। আল্লাহ হচ্ছেন রুহ এবং যারা তাঁর এবাদত করবে, তাদের অবশ্যই রুহে ও সত্যে তাঁর এবাদত করতে হবে।”

মহিলা তাঁকে বললো, “আমি জানি যে, মসিহ আসছেন। তিনি যখন আসবেন তখন সবকিছু আমাদের জানাবেন।” হযরত ইসা আ. তাকে বললেন, “আমিই তিনি, যিনি তোমার সাথে কথা বলছেন।”

তখনই তাঁর সাহাবিরা এলেন। একজন মহিলার সাথে তাঁকে কথা বলতে দেখে তাঁরা আশ্চর্য হলেন কিন্তু কেউ বললেন না, “আপনি কী চান?” অথবা “কেনো এই মহিলার সাথে কথা বলছেন?” তখন মহিলাটি তার পানির কলস রেখে শহরে ফিরে গেলো। সে লোকদের বললো, “এসো এবং একজন লোককে দেখো! আমি জীবনে যা-কিছু করেছি তার সবই তিনি আমাকে বলে দিয়েছেন! তিনি কি মসিহ হতে পারেন? তাঁকে কি মসিহ বলে মনে হয় না?” তারা শহর থেকে বেরিয়ে তাঁর কাছে ছুটলো।

এদিকে সাহাবিরা তাঁকে জোর অনুরোধ করতে লাগলেন, “হুজুর, কিছু খান।” কিন্তু তিনি তাঁদের বললেন, “আমার কাছে এমন খাবার আছে, যার বিষয়ে তোমরা জানো না।” সাহাবিরা একজন আরেকজনকে বলতে লাগলেন, “নিশ্চয়ই কেউ তাঁকে কোনো খাবার দেয়নি?” হযরত ইসা আ. তাদের বললেন, “যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন তাঁর ইচ্ছা পালন করা ও তাঁর কাজ পূর্ণ করাই হলো আমার খাবার।” তোমরা কি বলো না যে, ‘ফসল কাটার আর চার মাস বাকি আছে?’ কিন্তু আমি তোমাদের বলছি, তোমাদের চারপাশে তাকাও এবং দেখো যে, ফসল কাটার জন্য ক্ষেত কীভাবে তৈরি হয়ে আছে।

এরই মধ্যে ফসল সংগ্রহকারী মজুরি পাচ্ছে এবং আল্লাহর দিদার লাভের জন্য ফসল সংগ্রহ করছে, যেনো বপনকারী ও সংগ্রহকারী একত্রে আনন্দ পায়। কারণ এক্ষেত্রেই তো এই প্রচলিত কথাটি সত্য বলে প্রমাণিত হয়- ‘একজনে বীজ বনে আর অন্যজনে কাটে।’ আমি তোমাদেরকে এমন এক ফসল কাটতে পাঠিয়েছি, যার জন্য তোমরা কোনো পরিশ্রম করোনি; পরিশ্রম করেছে অন্যেরা আর তোমরা তার সুফল ভোগ করছো।”

“আমি জীবনে যা-কিছু করেছি তার সবই তিনি আমাকে বলে দিয়েছেন!”- সেই মহিলার এই সাক্ষ্য শুনে সামেরিয়ার অনেক লোক ইমান এনেছিলো। সুতরাং সামেরীয়রা যখন তাঁর কাছে এলো, তখন তারা তাঁকে অনুরোধ করলো তাদের সাথে থাকার জন্য; আর তিনি তাদের সাথে দুদিন থাকলেন। ফলে তাঁর কথায় আরো অনেকে ইমান আনলো। তারা মহিলাকে বললো, “এখন আর আমরা তোমার কথায় ইমান আনছি না, কারণ এখন আমরা নিজেদের কানে শুনেছি এবং আমরা জানি যে, ইনিই দুনিয়ার আসল নাজাতকারী।”

দুদিন পার হলে পর হযরত ইসা আ. সেখান থেকে গালিলের উদ্দেশে রওনা হলেন। তিনি নিজেই বলেছিলেন যে, কোনো নবিই নিজের দেশে সম্মান পান না। তিনি গালিলে আসার পর সেখানকার লোকেরা তাঁকে স্বাগত জানালো, কারণ তারা ইদের সময় জেরুসালেমে তাঁর কাজ দেখেছিলো; তারাও ইদে গিয়েছিলো।

অতঃপর তিনি গালিলের কান্না গ্রামে এলেন; এখানেই তিনি পানিকে আঙুররসে পরিণত করেছিলেন। সেখানে একজন রাজকর্মকর্তা ছিলেন, যাঁর ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো কফরনাহুমে। তিনি যখন শুনলেন যে, হযরত ইসা আ. ইহুদিয়া থেকে গালিলে এসেছেন, তখন তিনি গিয়ে কাকুতি-মিনতি করলেন, যেনো তিনি এসে তাঁর ছেলেকে সুস্থ করেন, কারণ সে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলো। হযরত ইসা আ. তাঁকে বললেন, “চিহ্ন বা মোজেজা না দেখলে আপনি ইমান আনবেন না।” কর্মকর্তা তাঁকে বললেন, “জনাব, আমার ছোটো ছেলেটি মারা যাবার আগে আসুন।” হযরত ইসা আ. তাঁকে বললেন, “যান, আপনার ছেলে বাঁচবে।” লোকটি তাঁর কথায় ইমান আনলেন এবং তাঁর পথে চলে গেলেন।

যখন তিনি যাচ্ছিলেন, তখন পথে তাঁর গোলামদের সাথে দেখা হলো এবং তারা তাঁকে জানালো যে, তাঁর সন্তান জীবিত রয়েছে। তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন যে, কখন সে সুস্থ হতে আরম্ভ করেছে। তারা তাঁকে বললো, “গতকাল দুপুর একটার সময় তার জ্বর ছেড়ে গেছে।” পিতা বুঝতে পারলেন যে, ঠিক ওই সময়ই হযরত ইসা আ. তাঁকে বলেছিলেন, “আপনার ছেলে বাঁচবে।” অতএব, তিনি ও তাঁর পরিবারের সবাই ইমান আনলেন। ইহুদিয়া থেকে গালিলে আসার পর হযরত ইসা আ. চিহ্ন হিসেবে এই দ্বিতীয় মোজেজা দেখালেন।