কালিমাতুল্লাহঃ রুকু-১

3370
Total
Visitors

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম ॥

 

শুরু থেকেই আল্লাহ আছেন। আল্লাহর কালাম তাঁর নিজের মধ্যেই ছিলো, এই কালামই হলো আল্লাহর কথা। আল্লাহ্ তাঁর কথা দ্বারাই সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। তাঁর মুখের কথা ছাড়া কিছুই সৃষ্টি হয়নি। আল্লাহর কালাম জীবন্ত এবং তা মানুষের জন্য আলো। আর এই কালাম অন্ধকারে আলো দিচ্ছিলো আর অন্ধকার তা গ্রহন করেনি।           

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা একজন মানুষকে পাঠালেন, তাঁর নাম ছিলো হযরত ইয়াহিয়া আ.। তিনি আলোর বিষয়ে সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন, যেনো সকলে তার দ্বারা ইমান আনতে পারে। তিনি নিজে সেই আলো ছিলেন না কিন্তু তিনি সেই আলোর বিষয়ে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন। প্রত্যেকের ওপর আলো দানকারী সেই সত্য আলো দুনিয়াতে আসছিলো।

আলো দুনিয়াতে ছিলো এবং দুনিয়া তাঁর দ্বারাই হয়েছিলো, তবুও দুনিয়া তাঁকে জানলো না। যা-কিছু তার নিজের, তিনি তার মধ্যেই এলেন কিন্তু তারা তাঁকে গ্রহণ করলো না। তবে যতোজন তাঁকে গ্রহণ করলো, যারা তাঁর নামের ওপরে ইমান আনলো, তিনি তাদের আল্লাহর সান্নিধ্যপ্রাপ্ত হওয়ার অধিকার দিলেন। এই অধিকার রক্ত থেকে হয়নি, শারীরিক কামনা বা পুরুষের বাসনা থেকেও হয়নি কিন্তু আল্লাহ্ থেকেই হয়েছে।

আল্লাহর কালাম মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করে আমাদের মধ্যে বাস করলেন এবং আমরা তাঁর মহিমা দেখেছি; কোনো পিতার একমাত্র ছেলের মহিমার মতো, যা রহমতে ও সত্যে পরিপূর্ণ।

হযরত  ইয়াহিয়া আ. তাঁর বিষয়ে জোর গলায় সাক্ষ্য দিয়ে বললেন, “ইনিই তিনি, যাঁর বিষয়ে আমি বলেছিলাম, ‘যিনি আমার পরে আসছেন, তিনি আমার চেয়ে মহান, কারণ তিনি আমার আগে থেকেই ছিলেন।’” আমরা সবাই তাঁর পূর্ণতা থেকে রহমতের ওপর রহমত পেয়েছি। 

নিশ্চয়ই হযরত মুসা আ. এর মাধ্যমে শরিয়ত দেয়া হয়েছিলো কিন্তু হযরত ইসা মসিহের মধ্য দিয়ে রহমত ও সত্য এসেছে। আল্লাহকে কেউ কখনো দেখেনি। তাঁর একমাত্র একান্ত প্রিয় মনোনীত জন, তাঁকে প্রকাশ করেছেন। 

যখন জেরুসালেম থেকে ইহুদিরা তাদের ইমামদের ও লেবীয়দের হযরত ইয়াহিয়া আ. এর কাছে জানতে পাঠালেন, তখন তিনি তাঁদের কাছে এই সাক্ষ্যই দিলেন। তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কে?” তিনি স্বীকার করলেন এবং অস্বীকার করলেন না; বরং স্বীকার করলেন যে, “আমি মসিহ নই।” তাঁরা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, “তবে কে? আপনি কি হযরত ইলিয়াস আ.?” তিনি বললেন, “না, আমি নই।” “আপনি কি সেই নবি?” জবাবে তিনি বললেন, “না।”

তখন তাঁরা তাঁকে বললেন, “তাহলে আপনি কে? যারা আমাদের পাঠিয়েছে, ফিরে গিয়ে তাদের তো জবাব দিতে হবে। আপনার নিজের সম্বন্ধে আপনি কী বলেন?” তিনি বললেন, নবি হযরত ইসাইয়া আ. যেমন বলেছেন, “আমি একজনের কণ্ঠস্বর, যে মরুপ্রান্তরে চিৎকার করে জানাচ্ছে, “তোমরা মালিকের পথ সোজা করো।”

যাঁদেরকে ফরিসিদের কাছ থেকে পাঠানো হয়েছিলো, তাঁরা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, “যদি আপনি মসিহ নন, হযরত ইলিয়াস আ.ও নন, কিংবা সেই নবিও নন, তাহলে কেনো বায়াত দিচ্ছেন?”

তিনি জবাবে তাঁদের বললেন, “আমি পানিতে বায়াত দিচ্ছি। আপনাদের মধ্যে একজন আছেন, যাঁকে আপনারা চেনেন না; উনিই তিনি, যিনি আমার পরে আসছেন। আমি তাঁর জুতার ফিতা খোলার যোগ্যও নই।” জর্দান নদীর ওপারে, বেথানিয়ায়, যেখানে হযরত ইয়াহিয়া আ. বায়াত দিচ্ছিলেন, সেখানে এসব ঘটেছিলো।

পরদিন  তিনি হযরত ইসা আ.কে তাঁর নিজের দিকে আসতে দেখে বলেন, “ওই দেখো, আল্লাহর মেষশাবক, যিনি দুনিয়া থেকে গুনাহ দূর করেন। ইনিই তিনি, যাঁর বিষয়ে আমি বলেছিলাম- ‘আমার পরে একজন আসছেন, যিনি আমার চেয়ে মহান, কারণ তিনি আমার আগে থেকেই আছেন।’ আমি নিজে তাঁকে চিনতাম না কিন্তু তিনি যেনো বনি-ইসরাইলের কাছে প্রকাশিত হন, সেজন্য আমি এসে পানিতে বায়াত দিচ্ছি।”

হযরত ইয়াহিয়া আ. এই সাক্ষ্য দিলেন, “আমি আল্লাহর রুহকে কবুতরের মতো হয়ে আসমান থেকে নেমে আসতে এবং তাঁর ওপরে বসে থাকতে দেখেছি। আমি নিজে তাঁকে চিনতাম না কিন্তু যিনি আমাকে পানিতে বায়াত দিতে পাঠিয়েছেন, তিনিই আমাকে বলে দিয়েছেন, ‘যাঁর ওপরে আমার রুহকে নেমে এসে থাকতে দেখবে, তিনিই সেই, যিনি আমার রুহে বায়াত দেবেন।’ এবং আমি নিজে তা দেখেছি এবং সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, ইনিই আল্লাহর একান্ত প্রিয় মনোনীতজন।”

পরদিন হযরত ইয়াহিয়া আ. ও তাঁর দুজন সাহাবি আবার সেখানে ছিলেন। হযরত ইসা আ.কে হেঁটে যেতে দেখে তিনি বললেন, “ওই দেখো, আল্লাহর মেষশাবক।” সেই দু’জন সাহাবি তাঁর একথা শুনলেন এবং হযরত ইসা আ. এর পেছনে পেছনে যেতে লাগলেন। তিনি পেছন ফিরে তাঁদের আসতে দেখে বললেন, “তোমরা কীসের খোঁজ করছো?” তাঁরা তাঁকে বললেন, “হুজুর, আপনি কোথায় থাকেন?” তিনি তাঁদের বললেন, “এসো এবং দেখো।” তাঁরা এলেন ও দেখলেন তিনি কোথায় থাকেন এবং সেই দিন তাঁরা তাঁর সাথেই রইলেন। তখন বিকেল প্রায় চারটে।

হযরত ইয়াহিয়া আ. এর কথা শুনে যে-দুজন তাঁর পেছনে পেছনে গিয়েছিলেন, তাঁদের একজন সাফওয়ান পিতরের ভাই আন্দ্রিয়ান। তিনি প্রথমে তাঁর ভাই সাফওয়ানকে খুঁজে বের করলেন এবং বললেন, “আমরা মসিহের দেখা পেয়েছি।” তিনি সাফওয়ানকে হযরত ইসা আ. এর কাছে আনলেন, আর তখন হযরত ইসা আ. তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি সাফওয়ান ইবনে ইউহোন্না কিন্তু তোমাকে কৈফা অর্থাৎ পিতর বলে ডাকা হবে।”

পরদিন তিনি গালিলে যাবেন বলে ঠিক করলেন। তিনি ফিলিপকে পেয়ে বললেন, “এসো, আমার অনুসারী হও।” ফিলিপ ছিলেন বেতসাইদার লোক। আন্দ্রিয়ান এবং পিতরও ওই একই গ্রামের লোক ছিলেন। ফিলিপ নথনেলকে খুঁজে বের করে বললেন, তওরাত শরিফে হযরত মুসা আ. যাঁর কথা বলে গেছেন এবং যাঁর বিষয়ে নবিরাও লিখেছেন, আমরা তাঁর দেখা পেয়েছি; তিনি নাসরতের হযরত ইসা আ.।” নথনেল ফিলিপকে বললেন, “নাসরত থেকে কি ভালো কোনোকিছু আসতে পারে?” ফিলিপ তাঁকে বললেন, “এসে দেখো।” হযরত ইসা আ. নথনেলকে নিজের দিকে আসতে দেখে তাঁর বিষয়ে বললেন, “ওই দেখো, একজন সত্যিকারের ইস্রাইলীয়, যার মনে কোনো ছলনা নেই।” নথলেন তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কেমন করে আমাকে চিনলেন?” তিনি উত্তরে বললেন, “ফিলিপ তোমাকে ডাকার আগে ডুমুরগাছের নিচে তোমাকে দেখেছিলাম।” নথনেল বললেন, “হুজুর, আপনিই আল্লাহর একান্ত প্রিয় মনোনীতজন! আপনিই বনি-ইস্রাইলের বাদশাহ!”

উত্তরে হযরত ইসা আ. বললেন, “‘তোমাকে ডুমুরগাছের নিচে দেখেছিলাম’, বলায় কি তুমি ইমান আনলে? এর চেয়ে আরো মহৎ ব্যাপার তুমি দেখতে পাবে।” এবং তিনি তাকে আরো বললেন, “আমি তোমাকে সত্যি সত্যিই বলছি, তুমি বেহেস্ত খোলা দেখবে এবং আল্লাহর ফেরেশতাদের ইবনুল-ইনসানের ওপরে নামতে এবং উঠতে দেখবে।”