ইবনুল-ইনসানঃ রুকু-১

3354
Total
Visitors

১) ১,২ মাননীয় থিয়ফিল, আমাদের মধ্যে যেসব ঘটনা ঘটেছে তা যাঁরা প্রথম থেকে নিজের চোখে দেখেছেন ও আল্লাহর কালাম প্রচার করেছেন, তাঁরা আমাদের কাছে সমস্ত বিষয় জানিয়েছেন, আর তাঁদের কথামতোই অনেকে সেসব বিষয় পরপর সাজিয়ে লিখেছেন। ৩ সেসব বিষয় সম্বন্ধে প্রথম থেকে ভালোভাবে খোঁজখবর নিয়ে আপনার জন্য তা একটি একটি করে লেখা আমিও ভালো মনে করলাম; ৪ এর ফলে আপনি যা জেনেছেন তা সত্যি/নিরাপদ কিনা জানতে পারবেন।

২) ৫ ইহুদিয়া প্রদেশের বাদশা হেরোদের সময় ইমাম আবিযার বংশের যাঁরা ইমাম ছিলেন, জাকারিয়া ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন। তাঁর স্ত্রী ছিলেন হারুনের বংশধর এবং তাঁর নাম ছিলো ইলিছাবেত। ৬তাঁরা দু’জনই আল্লাহর চোখে দীনদার ছিলেন এবং আল্লাহর বাধ্য থেকে তাঁর সমস্ত হুকুম নিখুঁতভাবে পালন করতেন। ৭তাঁদের কোনো ছেলেমেয়ে ছিলো না, কারণ ইলিছাবেত ছিলেন বন্ধ্যা এবং তাঁদের বয়সও খুব বেশি হয়ে গিয়েছিলো।

৩) ৮একবার নিজের দলের পালার সময় তিনি ইমাম হিসেবে আল্লাহর ইবাদত করছিলেন। ৯ইমাম নির্বাচনের প্রচলিত নিয়ম অনুসারে ভাগ্যপরীক্ষা দ্বারা তাঁকেই বেছে নেয়া হয়েছিলো, যেনো তিনি বায়তুল-মোকাদ্দসের পবিত্র-স্থানে গিয়ে সুগন্ধি জ্বালাতে পারেন। ১০জাকারিয়া যখন সুগন্ধি জ্বালাচ্ছিলেন, তখন সমাজের সব লোক বাইরে মোনাজাত করছিলো।

৪) ১১এমন সময় সুগন্ধি জ্বালানোর স্থানের ডান দিকে আল্লাহর এক ফেরেশতা হঠাৎ এসে তাঁকে দেখা দিলেন। ১২তাঁকে দেখে জাকারিয়া অস্থির হয়ে উঠলেন এবং ভয় তাঁকে গ্রাস করলো। ১৩ফেরেশতা তাঁকে বললেন, “জাকারিয়া, ভয় করো না, কারণ তোমার মোনাজাত কবুল হয়েছে। তোমার স্ত্রী ইলিছাবেতের একটি ছেলে হবে এবং তুমি তার নাম রাখবে ইয়াহিয়া। ১৪সে তোমার খুশি ও আনন্দের কারণ হবে এবং তার জন্মে আরো অনেকে আনন্দিত হবে; ১৫কারণ আল্লাহর চোখে সে মহান হবে। সে কখনো আঙুররস বা নেশাজাতীয় কোনোকিছু পান বা গ্রহণ করবে না। এমনকি মায়ের গর্ভে থাকতেই সে আল্লাহর রুহে পূর্ণ হবে ।

৫) ১৬বনি-ইসরাইলের অনেককেই সে তাদের মালিক আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে ফিরিয়ে আনবে। ১৭সে ইলিয়াসের রুহ ও ক্ষমতা নিয়ে তাঁর আগে আসবে, যেনো সে পিতার মন সন্তানের দিকে, অবাধ্যদের দীনদারীর জ্ঞানের দিকে ফেরাতে এবং আল্লাহর জন্য একদল লোককে প্রস্তুত করতে পারে ।”

৬) ১৮জাকারিয়া ফেরেশতাকে বললেন, “এসব যে ঘটবে তা আমি কীভাবে বুঝবো? কারণ আমি তো বৃদ্ধ হয়েছি এবং আমার স্ত্রীও বৃদ্ধা।” ১৯ফেরেশতা তাঁকে বললেন, “আমি জিবরাইল, আমি আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। তোমার সাথে কথা বলার ও তোমাকে এই সুখবর দেবার জন্য আমাকে পাঠানো হয়েছে । ২০আমার কথা সময়মতোই পূর্ণ হবে কিন্তু তুমি আমার কথায় ইমান আনোনি বলে যতোদিন এসব না ঘটে, ততোদিন কথা বলতে পারবে না- বোবা হয়ে থাকবে।”

৭) ২১এদিকে লোকেরা জাকারিয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলো। বায়তুল-মোকাদ্দসের পবিত্র-স্থানে তাঁর দেরি হচ্ছে দেখে তারা চিন্তা করতে লাগলো। ২২তিনি যখন বেরিয়ে এলেন, তখন তাদের সাথে কথা বলতে পারলেন না। এতে তারা বুঝতে পারলো যে, তিনি সেখানে কোনোকিছু দেখেছেন। তিনি তাদের কাছে ইসারা করতে থাকলেন কিন্তু কথা বলতে পারলেন না। ২৩ইমামতির কাজ শেষ হওয়ার পর তিনি বাড়ি ফিরে গেলেন।

৮) ২৪ওই দিনগুলোর পর তাঁর স্ত্রী ইলিছাবেত গর্ভবতী হলেন এবং পাঁচ মাস পর্যন্ত বাড়ি ছেড়ে বাইরে গেলেন না। ২৫তিনি বললেন, “আল্লাহ আমার জন্য একাজ করেছেন। মানুষের কাছে আমার লজ্জা দূর করার জন্য তিনি আমার প্রতি নজর দিয়েছেন।”

=====

৯) ২৬তাঁর যখন ছ’মাসের গর্ভ, তখন আল্লাহ গালিলের নাসরত গ্রামের এক কুমারীর কাছে জিবরাইল ফেরেশতাকে পাঠিয়ে দিলেন। ২৭দাউদের বংশের ইউসুফ নামে এক লোকের সাথে তাঁর বিয়ে ঠিক হয়েছিলো। সেই কুমারীর নাম ছিলো মরিয়ম। ২৮তিনি তাঁর কাছে এসে তাঁকে বললেন, “আসসালামু আলাইকুম, হে অনুগ্রহপ্রাপ্তা; আল্লাহ তোমার সাথে আছেন!” ২৯কিন্তু একথা শুনে তিনি হতবাক হয়ে গেলেন এবং ভাবতে লাগলেন এই সালামের মানে কী!

১০) ৩০ফেরেশতা তাঁকে বললেন, “মরিয়ম, ভয় করো না, কারণ তুমি আল্লাহর রহমত পেয়েছো। ৩১এখন তুমি গর্ভবতী হবে আর তোমার একটি ছেলে হবে। তুমি তাঁর নাম রাখবে ইসা। ৩২তিনি মহান হবেন; তাঁকে সর্বশক্তিমানের একান্ত প্রিয় মনোনীতজন বলা হবে এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর পূর্বপুরুষ দাউদের সিংহাসন তাঁকে দেবেন। ৩৩তিনি ইয়াকুবের বংশের লোকদের ওপর চিরকাল রাজত্ব করবেন; তাঁর রাজত্ব কখনো শেষ হবে না।”

১১) ৩৪মরিয়ম ফেরেশতাকে বললেন, “এটি কীভাবে হবে, আমি তো এখনো কুমারী?” ৩৫ফেরেশতা তাঁকে বললেন, “আল্লাহর রুহ্ তোমার ওপর আসবেন এবং সর্বশক্তিমানের শক্তি তোমাকে ছায়া দেবে। এজন্য যে-সন্তানের জন্ম হবে, তিনি হবেন পবিত্র এবং তাঁকে আল্লাহর একান্ত প্রিয় মনোনীতজন বলে ডাকা হবে। ৩৬দেখো, এই বৃদ্ধ বয়সে তোমার আত্মীয়া ইলিছাবেতের গর্ভেও ছেলের জন্ম হয়েছে। লোকে তাকে বন্ধ্যা বলতো কিন্তু এখন তার ছ’মাসের গর্ভ চলছে। ৩৭আসলে, আল্লাহর পক্ষে কোনোকিছুই অসম্ভব নয় ।” ৩৮মরিয়ম বললেন, “আমি আল্লাহর দাসী; আপনার কথামতোই আমার প্রতি তা হোক।” এরপর ফেরেশতা তাঁর কাছ থেকে চলে গেলেন।

১২) ৩৯ ওই দিনগুলোতে মরিয়ম ইহুদিয়া প্রদেশের পাহাড়ি এলাকার একটি গ্রামে গিয়ে থাকলেন। ৪০তিনি সেখানে জাকারিয়ার বাড়িতে ঢুকে ইলিছাবেতকে সালাম জানালেন। ৪১ইলিছাবেত যখন মরিয়মের সালাম শুনলেন, তখন তাঁর গর্ভের শিশুটি নেচে উঠলেন এবং ইলিছাবেত আল্লাহর রুহে পূর্ণ হলেন। ৪২তিনি জোরে চিৎকার করে বললেন, “মহিলাদের মধ্যে তুমি রহমতপ্রাপ্তা এবং তোমার গর্ভের ফলও রহমতপ্রাপ্ত। ৪৩আমার প্রতি কেনো এমন হলো যে, আমার মনিবের মা আমার কাছে এসেছে? ৪৪কারণ তোমার সালাম শোনার সাথে সাথে আমার গর্ভের শিশুটি আনন্দে নেচে উঠলো। ৪৫সে-ই ভাগ্যবতী, যে বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তার কাছে যা বলেছেন তা পূর্ণ হবে।”

১৩) ৪৬মরিয়ম বললেন, “আমার হৃদয় আল্লাহর প্রশংসা করছে, ৪৭আমার অন্তর আমার নাজাতদাতা আল্লাহর প্রশংসা করছে, ৪৮কারণ তিনি তাঁর এই সামান্য দাসীর দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। নিশ্চয়ই এখন থেকে সর্বকালের লোকেরা আমাকে ভাগ্যবতী বলবে । ৪৯কারণ সর্বশক্তিমান আমার জন্য মহৎ কাজ করেছেন- সুবহান আল্লাহ! ৫০যারা তাঁকে ভয় করে, বংশের পর বংশ ধরেই, তিনি তাদের দয়া করেন। ৫১তিনি নিজ হাতে মহাশক্তির কাজ করেছেন। তিনি অহঙ্কারীদের অহঙ্কারী চিন্তা ধ্বংস করে দিয়েছেন। ৫২তিনি সিংহাসন থেকে ক্ষমতাশালীদের নামিয়ে দিয়েছেন এবং অবহেলিতদের উন্নত করেছেন । ৫৩ক্ষুধার্তদের তিনি ভালো ভালো জিনিস দিয়ে সন্তুষ্ট করেছেন এবং ধনীদের খালি হাতে বিদায় করেছেন। ৫৪তিনি তাঁর রহমতের কথা স্মরণ করে তাঁর বান্দা ইসরাইলকে দয়া করেছেন। ৫৫আমাদের পূর্বপুরুষ ইব্রাহিম ও তাঁর বংশের প্রতি চিরকালের ওয়াদার কথা তিনি মনে রেখেছেন।” ৫৬মরিয়ম প্রায় তিন মাস তাঁর কাছে থাকার পর নিজের বাড়িতে ফিরে গেলেন। ৫৭সন্তান প্রসবের সময় হলে ইলিছাবেত একটি ছেলের জন্ম দিলেন।

১৪) ৫৮তাঁর প্রতিবেশী ও আত্মীয়রা শুনলো যে, আল্লাহ তাঁর প্রতি অশেষ দয়া করেছেন এবং তারা তাঁর সাথে আনন্দ করলো। ৫৯আট দিনের দিন তারা ছেলেটির খতনা করাতে এলো এবং ছেলেটির নাম তার পিতার নামানুসারে জাকারিয়া রাখতে চাইলো । ৬০কিন্তু তাঁর মা বললেন, “না, তাকে ইয়াহিয়া বলে ডাকা হবে।” ৬১তারা তাকে বললো, “ওই নাম তো আপনার আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে কারো নেই।” ৬২তখন তারা ইসারায় ছেলেটির পিতার কাছে জানতে চাইলো, তিনি কী নাম রাখতে চান। ৬৩তিনি লেখার জিনিস চেয়ে নিয়ে লিখলেন, “ওর নাম হবে ইয়াহিয়া।” এতে সবাই অবাক হলো।

১৫) ৬৪তখনই তাঁর মুখ খুলে গেলো ও তার জিভ মুক্ত হলো এবং তিনি কথা বলতে ও আল্লাহর প্রশংসা করতে লাগলেন। ৬৫এতে প্রতিবেশীরা সবাই ভয় পেলো। আর ইহুদিয়ার সমস্ত পাহাড়ি এলাকার লোকেরা এসব বিষয়ে বলাবলি করতে লাগলো। ৬৬যারা এসব কথা শুনলো, তারা প্রত্যেকেই মনে মনে ভাবতে লাগলো আর বললো, “এই ছেলেটি তাহলে কী হবে? নিশ্চয়ই আল্লাহ তার সাথে আছেন!”

১৬) ৬৭তাঁর পিতা জাকারিয়া আল্লাহর রুহে পূর্ণ হয়ে এই ভবিষ্যদ্বাণী করলেন- ৬৮“ইসরাইলের মালিক আল্লাহর প্রশংসা হোক; কারণ তিনি তাঁর নিজের লোকদের উদ্ধারের জন্য এসেছেন ও তাদের মুক্ত করেছেন। ৬৯,৭০অনেক আগেই পবিত্র নবিদের মাধ্যমে তিনি যেকথা বলেছিলেন, সেই কথা অনুসারে তাঁর বান্দা দাউদের বংশ থেকে আমাদের জন্য এক ক্ষমতাশালী নাজাতদাতাকে তুলেছেন , ৭১যেনো শত্রুদের এবং যারা আমাদের ঘৃণা করে, তাদের হাত থেকে আমরা রক্ষা পাই।

১৭) ৭২-৭৫তিনি আমাদের পূর্বপুরুষ ইব্রাহিমের কাছে তাঁর করা ওয়াদা এবং আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রতি তাঁর দয়া ও পবিত্র চুক্তির কথা স্মরণ করেছেন, যেনো তিনি শত্রুদের হাত থেকে আমাদের উদ্ধার করেন এবং আমরা চিরদিন নির্ভয়ে, পবিত্রতার সাথে ও সৎভাবে তাঁর এবাদত করতে পারি।

১৮) ৭৬হে আমার সন্তান, তোমাকে সর্বশক্তিমানের নবি বলা হবে; কারণ তুমি মনিবের পথ প্রস্তুত করার জন্য তাঁর আগে আগে যাবে । ৭৭তুমি তাঁর লোকদের গুনাহ মাফের মাধ্যমে কীভাবে নাজাত পাওয়া যায় তা জানাবে, কারণ ৭৮আল্লাহর মহাদয়ায় বেহেস্ত থেকে এক উঠন্ত সুর্যের আলো আমাদের ওপর প্রকাশিত হবে, ৭৯যেনো যারা অন্ধকারে ও মৃত্যুর ছায়ায় বসে আছে, তাদের আলো দিতে এবং আমাদেরকে শান্তির পথে চালাতে পারেন ।” ৮০শিশুটি বেড়ে উঠলেন ও মানসিকভাবে শক্তিশালী হলেন এবং বনি-ইসরাইলের সামনে প্রকাশিত হওয়ার আগ পর্যন্ত নির্জন এলাকায় থাকলেন।